WannaCry র‍্যানসমওয়্যার – বিশ্বজুড়ে ছড়ানো সাইবার-হুমকি

তারিখ:

“চান্দু, তোমার সবকিছু আমাগো দখলে আছে, যদি সেসব ফেরত পেতে চাও, জলদি ট্যাকা দাও। ৭ দিনের মধ্যে ট্যাকা না পাইলে কিন্তু ডাবল দেওয়া লাগবে। আর কাউকে বলেছো তো মরেছো! জিন্দেগিতেও ফেরত পাইবানা তোমার সেলফি, ফাইল কিসুই। “

কী, এইগুলা কি গব্বর সিং কিংবা এটিএম শামসুজ্জামান মার্কা ভিলেনের ডায়ালগের মতো শোনাচ্ছে? নাহ, এগুলা বাস্তব ডায়ালগ, এবং এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ কম্পিউটার খোলামাত্র এই মেসেজটা দেখছেন। এবং আসলেই ৩০০ ডলার না দিতে পারলে তাঁরা হারাবেন তাঁদের সব ফাইল চিরতরে।

(RansomWare নিয়ে আগেও অনেক লিখেছি, কিন্তু গত কয়দিন যাবত সারাবিশ্বে তোলপাড় তুলেছে যে ওয়ানাক্রাই র‍্যানসমওয়্যার, তাকে নিয়েই আজকের এই লেখাটা। জনস্বার্থে শেয়ার করুন।)
RansomWare হলো সাইবার অপরাধীদের নতুন একটি অস্ত্র — কম্পিউটারে রাখা দরকারি ফাইলপত্র/ছবিকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের ফন্দি। গৎবাঁধা ভাইরাস যখন ফাইল ডিলিট করে বা অন্য কিছু করেই খালাস, র‍্যানসমওয়্যার ধরণের ভাইরাস তখন ব্যস্ত আপনার কম্পিউটারের সব ফাইলকে এনক্রিপ্ট করে দুর্বোধ্য করতে, আড়ালে বসে সেটা করা হয়ে গেলে আপনাকে অপরাধীরা আপনার কম্পিউটারেই একটা মেসেজ দিবে, সেখানে তারা জানাবে আপনার সবকিছু এখন তাদের দখলে, যদি ফেরত পেতে চান তাহলে ৭ দিনের মধ্যে ৩০০ ডলার মুক্তিপণ দিতে হবে।

কেবল তাই না, এই মুক্তিপণ দিতে হবে ডিজিটাল কারেন্সি বিটকয়েন এর মাধ্যমে, যা ট্রেস করা অত্যন্ত কঠিন, কাজেই কে টাকাটা নিচ্ছে, জানতেও পারবেন না। মুক্তিপণ দিয়ে অপরাধীদের খুশি করতে পারলে তারা ফাইলগুলো ডিক্রিপ্ট করার চাবিকাঠি বা key দিবে আপনাকে।

গত সপ্তাহ থেকে সারাবিশ্বে খুব বড় আকারে র‍্যানসমওয়্যার আক্রমণ শুরু হয়েছে, যার নাম WannaCry র‍্যানসমওয়্যার। এর আগেও র‍্যানসমওয়্যারের আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু এবারে এই আক্রমণ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, ১০০টির বেশি দেশের প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ কম্পিউটার হয়েছে আক্রান্ত। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের ৭০,০০০ কম্পিউটার আক্রান্ত, রেহাই পায়নি ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার নানা দেশের কম্পিউটারও।

এই র‍্যানসমওয়্যারটি মূলত অন্য সব ভাইরাসের মতোই ইমেইলে ছড়ায়, ভুলভাল লিংকে ক্লিক করে অথবা এটাচ করা ফাইল খুলে চালাতে গেলেই আপনার কম্পিউটার আক্রান্ত হবে। আর তার পর উইন্ডোজের নেটওয়ার্কের কিছু প্রটোকলের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একই নেটওয়ার্কের সর্বত্র ছড়াবে এটা। মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ১০ ব্যবহার করলে কিছুটা নিশ্চিত থাকতে পারেন, সেই অপারেটিং সিস্টেমে এই দুর্বলতাটি নাই। কিন্তু আগের উইন্ডোজ যেমন এক্সপি কিংবা উইন্ডোজ ৭ এ এই সমস্যা আছে। এই সমস্যাটির কথা প্রথম জানা যায় কয়েক মাস আগে NSA এর কিছু গোপন ফাইল শ্যাডোব্রোকারস নামের হ্যাকার গ্রুপটি ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়ার পর। মাইক্রোসফট সেটা আঁচ করতে পেরে মার্চে একটা সিকিউরিটি প্যাচ রিলিজ করে। কিন্তু অনেকেই সেটা ইন্সটল করেন নাই আলসেমি করে, অথবা পাইরেটেড উইন্ডোজ ব্যবহারের কারণে আপডেট পান নাই। তার উপরে আছে এক্সপি — মাইক্রোসফট ২০১৪ সাল এর পর থেকে এক্সপির আপডেট বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে এক্সপিতে চলা কম্পিউটার নানা সিকিউরিটি প্রবলেমে ভর্তি। অথচ দুনিয়ার লাখ লাখ কম্পিউটার এখনো উইন্ডোজ এক্সপিতেই চলছে।

তো এই র‍্যানসমওয়্যার থেকে বাঁচার উপায় কী? বাঁচতে হলে জানতে হবে।
১) ব্যাকআপ করেন সবকিছু। নিয়মিতভাবে। আপন যতোই সতর্ক হন না কেনো, সাবধানের মার নাই। ব্যাকাপ করবেন এমন জায়গায় যেখানে আপনার কম্পিউটার সরাসরি সবসময় লাগানো থাকে না (কারণ আপনার কম্পিউটার বেদখল হয়ে গেলে তো সেইখানের ফাইলও র‍্যানসমওয়্যার এনক্রিপ্ট করে ফেলবে, তাই না? তাই ক্লাউড ব্যাকাপ কিংবা পেন ড্রাইভে ব্যাকাপ করে খুলে রাখুন কম্পিউটার থেকে।

২) নিয়মিত আপডেট — অপারেটিং সিস্টেমকে নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করুন। সিকিউরিটি প্যাচ ইন্সটল করা বোরিং লাগলেও এটা করতে হবে।

৩) এন্টি ভাইরাস সফটওয়ার চালু রাখুন এবং সেটাকেও নিয়মিতভাবে আপডেট করুন।

৪) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ — নিজের অভ্যাস পাল্টান। ইমেইলে বা অন্যত্র এই লিংক সেই এটাচমেন্ট পেলেই ক্লিক করে বসা বাদ দিন। ফেইসবুকে যে যা পোস্ট করে, তাতে ক্লিক করে বসবেন না। পাইরেটেড সফটওয়ার ব্যবহার বাদ দেন, অনেক ক্ষেত্রেই সেসবের মাঝে ব্যাকডোর বসানো থাকে। আর সবকিছুকেই যাচাই করে নিবেন, পরিচিত কেউ মেইল করলে বা মেসেজ দিলেও সেটাকে যাচাই না করে ক্লিক করা বা এটাচমেন্ট ওপেন করা বাদ দিন।

[ আর যদি আক্রান্ত হয়েই যান এবং আপনার ফাইল সব এনক্রিপ্ট হয়ে যায়? আসলে এই ক্ষেত্রে করার কিছু নাই বললেই চলে। সাইবার অপরাধীরা এতো শক্তিশালী এনক্রিপশন ব্যবহার করছে যা ব্রেক করে ফাইল উদ্ধার অসম্ভব। কাজেই টাকা দিয়ে দিতেই হবে, নইলে ছাড়তে হবে ফাইলগুলার মায়া। ]

***পীরগঞ্জ টোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।***

রাগিব হাসান
রাগিব হাসান
কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. রাগিব হাসান বর্তমানে বার্মিংহামে আলমাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার এবং ইনফরমেশন সায়েন্সেস ডিপার্টমেন্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের এনএসএফ / সিআরএ কম্পিউটিং ইনোভেশন ফেলো (সিফ্লো) এবং রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইলিনয়েন্সের আরবানা-শ্যাম্পেইন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৪ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের নিরাপত্তার ওপর গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার সম্মানজনক পুরস্কার ‘ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম Shikkhok.com এর প্রতিষ্ঠাতা।

শেয়ার করুন:

Subscribe

জনপ্রিয়

এমন আরও
সম্পর্কিত

স্মার্টনেসের বিপদ! – রাগিব হাসান

অনেক কাল আগের শোনা একটা বাংলা সিনেমার গান দিয়ে...