স্মার্টনেসের বিপদ! – রাগিব হাসান

তারিখ:

অনেক কাল আগের শোনা একটা বাংলা সিনেমার গান দিয়ে শুরু করি —
“বেশি চালাক সাইজো না,
তোমার হাড়ির খবর আমি জানি জানি,
বাংলাদেশের জমির উদ্দিন,
আমেরিকায় সাজে মিস্টার জনি।”
(এর পরে হেই হেই এবং বিশালকায় নায়ক নায়িকার ভূমিকম্পসৃষ্টিকারী লাফ-ঝাঁপ আছে, তবে সেটা ব্যাপার না)।

আপনি জমিরউদ্দিন থেকে জনি কিংবা জমিলা থেকে জেমি হয়েছেন কিনা জানিনা, কিন্তু এটা বলতে পারি, এই স্মার্টনেসের যুগে আপনার হাড়ির খবর আসলেই কেউ না কেউ জানে, খুব ভালো করেই, এমনকি আপনার চাইতেও হয়তো ভালো করে জানে।

ফোনের কথাই ধরা যাক, ১০ বছর আগের ফোনগুলার কথা মনে আছে? বড়সড় ফোন, কিন্তু ডাম্ব ফোন, কেবল ফোন করা আর বড়জোর গান শোনা যেতো। কিন্তু এখন স্মার্টফোনের আমল, ঝঁকঝকে তকতকে স্মার্টফোন খুব সস্তায় এসে গেছে সবার হাতে। ভালোই তো, তাই না? কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়, এই স্মার্টফোনের ভিতরে গাদায় গাদায় সেন্সর দেয়া আছে, আপনার নড়াচড়া, হাঁটাচলা, কোথায় কী বলছেন করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, সবকিছুই সেসবে ধরা পড়ে। পকেটে রেখে ঘুরছেন? তাতে কী, ফোনের এক্সিলারোমিটারে আপনার নড়াচড়া দেখে দিব্যি বলে দেয়া সম্ভব আপনি কী করছেন। অথবা আপনি সারা দিনে কোথায় কোথায় গেছেন, তার সব খবর। নানা অ্যাপ জানিয়ে বা না জানিয়ে এসব রেকর্ড করছে, আপনার নামে গোপনে তাদের কাছে তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলছে।

অথবা ধরুন ফেইসবুকের কথা। দিব্যি আছেন এটা সেটা লাইক দিয়ে, পোস্টিয়ে, কিংবা কেবল ক্লিক করে। নাকি নাই। হুম, ফেইসবুক কিন্তু আপনার প্রতিটি মাউস ক্লিক কিংবা প্রতিটি ট্যাপের হিসাব রাখছে। আর ভিতরে ভিতরে আপনি কেমন মানুষ, আপনি কী চান, কী খান, কী পড়েন, কী পরেন, সবই বুঝে নিচ্ছে। ফেইসবুক আপনার সম্পর্কে কী জানে তা দেখলে অবাক হয়ে যাবেন (কিছু ক্রোম এক্সটেনশন দিয়ে সেটা দেখা যায়, আমি নিজে আমারটা দেখে অবাক হয়ে গেছি, ক্যামনে বুঝলো?)। এমনকী আপনি কোনো কিছু যেমন দাঁড়িওয়ালা ছাগলের নাচ নিয়ে হয়তো বলেনও নাই কিছু, কিন্তু ঐ টাইপের খবরগুলাতে বা ভিডিওতে ক্লিক টিক করেছেন, ব্যস ফেইসবুক বুঝে গেলো আপনি আসলে ছাগপ্রেমিক। লুকাবার জায়গা নাই!!

তার উপরে যোগ হয়েছে ট্রাকিং। মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন? আপনার সব সময়ের যাবতীয় গতিবিধি মোবাইল ফোন কোম্পানি খুব ভালো করে ট্রাক করতে পারে, এটা অবশ্য মোবাইলের আদি যুগ থেকেই চলছে। কিন্তু দোকানে কোন জায়গায় একটু থামছেন, কিসের সামনে দাঁড়াচ্ছেন, সেগুলাও খুব নিখুঁতভাবে ট্রাকিং এর প্রযুক্তি বেরিয়ে গেছে, আলট্রাসাউন্ড বা ব্লুটুথ বিকনের মাধ্যমে।

এগুলা নাহয় উড়িয়ে দিলেন আপনার গোপন কিছু নাই বলে, কিন্তু ভাবেন, আপনার জীবনের কতো কিছু এখন মোবাইল ফোন বা স্মার্ট প্রযুক্তি নির্ভর — সেই মোবাইল ফোনটা আপনার সাথেই থাকে সব সময়ে, অথচ গাদা গাদা সেন্সরে ভরা এই মোবাইল ফোনটা এক নিমেষে পরিণত হতে পারে গুপ্তচরে, আপনার সব হাড়ির খবর বের করে নিতে পারে। কেবল কি মোবাইল ফোন? মাত্র কিছুদিন আগে ফাঁস হয়ে গেলো, রোবটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার রুম্বা নাকি বাসা পরিষ্কারের সময়ে বাসার ভিতরে কোথায় কী আছে, তার খবর বের করে নেয়, আর সেই খবর পাচার করে তার কোম্পানিকে, সেই কোম্পানি খবরগুলা বাসার ভিতরের ম্যাপট্যাপ সব বেচে দেয় যে টাকা দিবে তাদের কাছে।

মূল সমস্যাটা আসলে প্রযুক্তির না আদৌ। প্রযুক্তি আছে থাকবে আর আমাদের জীবনকে সহজ করতে নতুন প্রযুক্তি আসবেই। সমস্যাটা হলো আমাদের বিশ্বাসপ্রবণতা, আমাদের নিরাপত্তাজ্ঞানশুণ্যতা নিয়ে। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে ভাববেন না জানবেন না জানার দরকার নাই এইটা করে পার পাবেন না, এই স্মার্টনেসের যুগে স্মার্ট ডিভাইসের আমলে আপনাকে সিকিউরিটির মূল জিনিষগুলা জানতে হবে বুঝতে হবে। এ নিয়ে পুরো এক মাস বলতে পারি কথা, কিন্তু আজকে কেবল একটাই বলবো, আপনার পকেটের গুপ্তচরটার ব্যাপারে সতর্ক হন। মোবাইল ফোনটিতে যেখান সেখান থেকে এটা সেটা অ্যাপ ইন্সটল না করাই ভালো। আর যে অ্যাপের কাজ গেইম খেলা, তার কি মাইক্রোফোন এক্সেস নেয়ার দরকার আছে? অথবা আপনার ছবির অ্যালবামে? তাই অ্যাপ পারমিশন যা চায় চোখ বুঁজে তা না দিয়ে একটু খেয়াল রাখুন।

গুপ্তচর ব্যাটা কিন্তু শুনছে। জানছে আপনার হাড়ির সব খবর।

অতি চালাক হওয়া সব সময় খারাপ তা ঠিক না, তবে চালাক না হয়ে হন বুদ্ধিমান।

***পীরগঞ্জ টোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।***

রাগিব হাসান
রাগিব হাসান
কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. রাগিব হাসান বর্তমানে বার্মিংহামে আলমাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার এবং ইনফরমেশন সায়েন্সেস ডিপার্টমেন্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের এনএসএফ / সিআরএ কম্পিউটিং ইনোভেশন ফেলো (সিফ্লো) এবং রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইলিনয়েন্সের আরবানা-শ্যাম্পেইন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৪ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের নিরাপত্তার ওপর গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার সম্মানজনক পুরস্কার ‘ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম Shikkhok.com এর প্রতিষ্ঠাতা।

শেয়ার করুন:

Subscribe

জনপ্রিয়

এমন আরও
সম্পর্কিত

WannaCry র‍্যানসমওয়্যার – বিশ্বজুড়ে ছড়ানো সাইবার-হুমকি

"চান্দু, তোমার সবকিছু আমাগো দখলে আছে, যদি সেসব ফেরত...